ঐতিহ্যের জনপদ পূর্ণ্যভূমি রাউজান

Raozan IT

ঐতিহ্যের জনপদ পূর্ণ্যভূমি রাউজান – পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে ১৯৭১ সালে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল একটি ভূখন্ড, যার নাম বাংলাদেশ।ভৌগোলিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের সিংহভাগ অঞ্চল জুড়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অবস্থিত। জনসংখ্যার বিচারে প্রায় ১৭ কোটিরও অধিক জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম দেশ।

ঐতিহ্যের জনপদ পূর্ণ্যভূমি রাউজান

বাংলাদেশ ৮টি বিভাগে সর্বমোট ৬৪টি জেলায় বিভক্ত। এবং সর্বপ্রথম প্রথম জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা। ১৭৭৬ সালে প্রণীত ব্রিটিশ মানচিত্রে চট্টগ্রাম সরকার। তখন চট্টগ্রাম নামটি সরকারি দলিলে প্রচলিত ছিল না। এর নাম ছিল ইসলামাবাদ, যা ১৬৬৬ সালে মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান রেখেছিলেন। স্থানীয়ভাবে ইসলামাবাদের আটপৌড়ে নাম ছিলো চাটিগাঁও। পরবর্তীতে তা চট্টগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যা ১৬৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার আরেক নাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’। ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ কথাটি বাংলাদেশের সর্বত্র বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত।

ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সুদূর আরব, ইরাক, ইরান বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য সুফি-সাধকরা বাংলার জমিনে আগমন করে। তাদের আধ্যাত্মিক সাধনা, ত্যাগের বিনিময়েই চট্টগ্রামের গ্রামগঞ্জের মানুষ ইসলামের ছায়া তলে আশ্রয় নেয়।

চট্টগ্রাম জেলা এটি ৪১ ওয়ার্ড বিশিষ্ট ১টি সিটি কর্পোরেশন, ১৫টি উপজেলা নিয়ে গঠিত যার মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যের আলোকিত জনপদ খ্যাত রাউজান উপজেলা। যার মোট আয়তন ২৪৬.৫৯ বর্গ কিমি এবং ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত যা রাবার উৎপাদন,বাঁশ, বেত ও পাটি পাতার তৈরী কুটির শিল্প ও সর্বশেষ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর জন্য বিশ্ব বিখ্যাত।

চট্টগ্রামের বুকে এক চিলতে রোদেলা আকাশ রাউজানঃ

বহমান উন্নয়নের স্রোতধারার ফলশ্রুতিতে দেশ-বিদেশের কাছে প্রিয় রাউজানের সুনাম দিন দিন ছড়িয়ে পড়েছে। মরণোত্তর একুশে পদক প্রাপ্ত গবেষক চট্টল তত্ত্ববিদ আবদুল হক চেীধুরী রচিত ‘রাউজান নামের উৎস’ বইয়ে রাউজান নামের নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে কক্সবাজারের বাসিন্দা আরাকানী ভাষার বংশোদ্ভুত রাখাইন মং হ্লা প্রু পিন্টুর বরাত দিয়ে জানানো হয় আরাকানী ভাষায় ছোট ছোট গ্রামকে রোয়াঙে এবং গ্রামের শেষ অংশকে রোয়াজোয়েঙ বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এই রোয়াজোয়েঙ শব্দটি কালের বিবর্তনে বিকৃত হয়ে ‘রাউজান’ নামের সূচনা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ইতিহাস গবেষকেরা মনে করেন রাউজান নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত থাকলে ও সময়ের পালাবদলে রাউজান একটি কিংবদন্তি জনপদে পরিণত হয়েছে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।

ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রনের লৌকিক কথা সাহিত্যের বিশিষ্ট চরিত্র শত কিংবদন্তি ও কৃতী ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান রাউজান। যার মধ্যে অন্যতম ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র যুগশ্রেষ্ঠ মহা মনীষী কাগতিয়া আলিয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত গাউছুল আজম (রাঃ) এবং কৃতী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আব্দুল জলিল শাহ (র:),আল্লামা রহুল আমিন রহঃ, ইন্জিনিয়ার আবদুল খালেক,কবি হামিদ আলীকবি,দৌলত কাজি,মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ,শিক্ষাবিদ তোফায়েল আহমদ,কলামিস্ট ‍হারুন-অর রশীদ,গবেষক আব্দুল হক চৌধুরী,মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরি,ছূফি ছেয়দুল হক শাহ। সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী,ফজলুল কাদের চৌধুরী,ভাষা সৈনিক আবদুল্লাহ-আল-হারুন,কবি মাহবুব আলম চৌধুরি,মুহাম্মদ আবদুল অদুদ চৌধুরী,মাষ্টারদা সূর্য সেন,নবীনচন্দ্র সেন,নূতন চন্দ্র সিংহ,সুকুমার বড়ুয়া,ড. বেণীমাধব বড়ুয়া সহ আরো অসংখ্য কৃত্তিত্ব ব্যক্তি রয়েছে এই রাউজানের বুকে।

তবে ঐতিহ্যের এই আলোকিত জনপদ একসময় বিভিষীকাময় সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে খ্যাতিমান্ ছিল।

প্রায় তিন দশক আগেও ছিল অপবাদের তকমা। রাউজানকে বলা হতো শ্রীলংকার ‘জাফনা’ কিংবা লেবাননের ‘বৈরুত’। খুন, রাহাজানি ও সন্ত্রাসের কারণে রাউজানকে ‘সন্ত্রাসের জনপদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো। তখন স্বস্তিতে ছিল না রাউজানের সাধারণ মানুষ। রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। খুন-খারাবির কারণে প্রত্যন্ত জনপদের সবুজ ঘাস হতো রক্তাক্ত। পাশাপাশি বিগত দুই দশক যাবত ছিল এক নায়ক তন্ত্র শাসন ব্যবস্থা। যা মানুষের বাক স্বাধীনতা কে হরণের মাধ্যমে নৈরাজ্যের অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। জনৈক ক্ষমতাসম্পন্ন গোষ্ঠীর মতের অমিল হলেই কঠিন হয়ে যেতো নিজ অস্তিত্ব রক্ষা! নাস্তিক্যবাদ লালনের মাধ্যমে তাদের আক্রোশ থেকে বাদ যাইনি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং ইসলামিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনায় বিশ্বাসীরাও। এই যেন আধুনিক যুগে নব্য ফেরাউন কিংবা ইসলামের ঐতিহ্যগত ইতিহাসে মুনাফিকদের সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই’র এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

রাউজানকে বলা হয় জ্ঞানী-গুণী,গউছ-পীর আউলিয়ার পীঠস্থান যাদের আধ্যাত্মিকতা তথা রিয়াজতের অনন্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে অশান্ত রাউজান কে ধীরে ধীরে শান্তির জনপদে পরিণত হচ্ছে। খুন,রাহাজানি ছেড়ে দলে দলে যুবসমাজ মাথায় টুপি এবং হাতে তসবি ও মেসওয়াক নিয়ে আল্লাহর পথে এবং দুরুদে মোস্তফার মাধ্যমে নিজ জীবন এবং যৌবন কে ইসলামের আলোয় আলোকিত করছে। পাশাপাশি ইসলামিক মূল্যবোধ এবং আধ্যাত্মিকতার অন্যান্য ছোঁয়ায় সময়ের ব্যবধানে সেই রাউজানের সেই চিরচেনা চিত্র কে বদলে দিয়ে পরিবর্তন করছে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট।

রাজনীতিতেও আঞ্চলিক ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে রাউজানের মানুষের পদচারণা রয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশায় রাউজানের অবস্থান অগ্রসরমান। শিক্ষা ক্ষেত্রেও রাউজানের ঈর্ষণীয় সফলতা রয়েছে। যেমন প্রকৌশল শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এর অবস্থান রাউজানে। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার থেকে অনন্য ভূমিকায় এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কাগতিয়া এশাতুল উলুম কামিল মাদরাসা এবং রাউজান দারুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসা সহ এমপিও ও নন এমপিও ভূক্ত সহ সর্বমোট প্রায় তেইশটির মতো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

পাশাপাশি সম্প্রতির এক অনন্য উদাহরণ দেখা যাই আলোকিত রাউজানে- মুসলিম, হিন্দু,বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের
অটুট এক মেলবন্ধন।

মনোভাব প্রকাশঃ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের এক জনপদ পূর্ণ্যভূমি রাউজান। সাধারণত পবিত্র ভূমি কে পূর্ণ্যভূমি বলা হয়,আমি আমার কলামে পূর্ণ্যভূমি শব্দটি আনার অন্যতম কারণ আল্লাহ আউলিয়া কেরামগণদের পদচারনায় ধন্য এই জনপদ। যা এক সময়ের বিভীষিকাময় জনপদ কে আলোকিত জনপদে রুপান্তরিত করেছে। পাশাপাশি তাদের আধ্যাত্মিকতা ও সূফীবাদ চর্চার মাধ্যমে হেদায়েতের নূর দ্বারা আলোকিত করছে হাজারো পথভ্রষ্ট মানুষের ক্বলব কে।

যাদের অফুরন্ত দয়ার ফসল হিসাবে সাক্ষাৎ দিচ্ছে এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র -হালদা। তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নদী থেকে পোনা আহরণের নজির থাকলেও হালদা ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নদীতে ডিম আহরণের নজির নেই। প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘হালদা নদী’- বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী এবং এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি ইউনেস্কো হালদাকে বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন উপযোগী নদী ঘোষনা করেছে। তাই বিশ্বের এই বিরল প্রাকৃতিক লীলা হালদা নদীর কারণেই রাউজান কে নিঃসন্দেহে পূর্ণ্যভূমি বলা চলে।

প্রিয় রাউজান কে নিয়ে যুব সমাজ ও সাধারণ মানুষের হাজারো প্রতাশ্যা। যেইখানে থাকবে না খুন, রাহাজানি, ঘুষ-দুর্নীতি, মিথ্যাচার, মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্তি, ন্যায় কে ন্যায় এবং অন্যায় কে অন্যায় বলার বাক স্বাধীনতা থাকবে সাধারণ নাগরিকের। পাশাপাশি সুস্থ সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সমাজে অশুভ শক্তি যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। তরুণ-যুব সমাজকে সঠিক পথে রাখার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। তাদের মানুষের মতো মানুষ করতে পারলে ইনশাআল্লাহ আরো বেশি আলোয় আলোকিত হবে ঐতিহ্যের জনপদ খ্যাত পূর্ণ্যভূমি রাউজান।

লেখক ছৈয়দ ফাহিম উল্লাহ

AL Sheraz